১. জন্মগত কারণ (Congenital Causes)
অনেক পুরুষের ক্ষেত্রে হার্নিয়া জন্মগত হতে পারে, যার মানে হল যে এটি জন্মের সময় থেকেই শরীরে বিদ্যমান থাকে। শিশুদের মধ্যে বিশেষ করে ইনগুইনাল হার্নিয়া (inguinal hernia) অনেক বেশি দেখা যায়, যা পুরুষদের মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ ধরনের হার্নিয়া।
- ইনগুইনাল ক্যানাল: পুরুষদের পেটের নিচে একটি ছোট খাল থাকে যেটি ইনগুইনাল ক্যানাল নামে পরিচিত। এই ক্যানালটি সাধারণত শিশুকালেই বন্ধ হয়ে যায়, তবে কখনও কখনও এটি পুরোপুরি বন্ধ না হওয়ার ফলে অন্ত্র বা অন্যান্য অঙ্গ এই স্থান দিয়ে বেরিয়ে আসে এবং হার্নিয়া সৃষ্টি হয়।
২. শারীরিক চাপ (Physical Strain)
যেকোনো ধরনের অতিরিক্ত শারীরিক চাপ হার্নিয়ার সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষ করে যখন এটি পেটের অংশে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। এর মধ্যে কিছু কারণ হতে পারে:
- ভারী কিছু তোলা: নিয়মিত ভারী ওজন তোলা (যেমন জিমে, কাজের ক্ষেত্রে) পেটের ভেতরের চাপ বৃদ্ধি করতে পারে, যা হার্নিয়ার কারণ হতে পারে।
- দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকা বা বসে থাকা: দীর্ঘ সময় বসে বা দাঁড়িয়ে থাকার ফলে পেটে চাপ তৈরি হয়, যা হার্নিয়ার সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
৩. কোষ্ঠকাঠিন্য (Constipation)
কোষ্ঠকাঠিন্য একটি বড় কারণ হতে পারে হার্নিয়া তৈরির। যখন আপনি কোষ্ঠকাঠিন্যের কারণে চেষ্টার সাথে মলত্যাগ করেন, তখন পেটে অতিরিক্ত চাপ তৈরি হয়, যা হার্নিয়ার সৃষ্টি করতে পারে। অতিরিক্ত চাপ পেটের দেয়াল দুর্বল করতে পারে এবং হার্নিয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।
৪. বয়স (Age)
বয়স বাড়ার সাথে সাথে শরীরের পেশী ও টিস্যুগুলি দুর্বল হতে থাকে, যার ফলে পেটের দেয়ালও দুর্বল হতে পারে। বয়সের সাথে, শরীরের টিস্যুগুলি প্রাকৃতিকভাবে আরও নমনীয় হয়ে পড়ে, এবং এর ফলে হার্নিয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। সাধারণত ৪০ বছর বয়সের পর পুরুষদের মধ্যে হার্নিয়া হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
৫. ওজন বৃদ্ধি (Obesity)
অতিরিক্ত শরীরের মেদ হার্নিয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি করতে পারে। অতিরিক্ত মেদ পেটে চাপ তৈরি করে, এবং এতে পেটের দেয়াল দুর্বল হয়ে যেতে পারে। যাদের উচ্চ ওজন বা মোটা হওয়ার প্রবণতা থাকে, তাদের মধ্যে হার্নিয়া হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
৬. ধূমপান (Smoking)
ধূমপানও হার্নিয়ার ঝুঁকি বাড়াতে পারে। এটি শরীরের টিস্যুগুলির শক্তি কমিয়ে দেয় এবং পেশীগুলির দুর্বলতা সৃষ্টি করতে পারে, যার ফলে হার্নিয়া হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
৭. পূর্ববর্তী সার্জারি (Previous Surgery)
যারা পেট বা অন্যান্য অংশে আগে কোনো ধরনের সার্জারি (যেমন অ্যাপেনডিসাইটিস অপারেশন, পেটের অস্ত্রোপচার) করেছেন, তাদের মধ্যে হার্নিয়ার সমস্যা হওয়া অনেক বেশি সম্ভব। অস্ত্রোপচারের কারণে পেটের দেয়াল দুর্বল হতে পারে, এবং এতে ইনসিজনাল হার্নিয়া (incisional hernia) হতে পারে।
৮. পারিবারিক ইতিহাস (Family History)
যদি পরিবারের মধ্যে কারও হার্নিয়া থাকে, তবে আপনারও হার্নিয়া হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। কিছু ক্ষেত্রে হার্নিয়া একটি বংশগত সমস্যা হতে পারে।
৯. আঘাত (Injury)
শরীরের কোনো অংশে আঘাত পাওয়ার কারণে পেটের দেয়াল দুর্বল হয়ে যেতে পারে, এবং এটি হার্নিয়ার সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষত যদি আঘাতের ফলে পেটের পেশী বা টিস্যুতে ক্ষতি হয়।
১০. গর্ভাবস্থা (Pregnancy)
যদিও এটি পুরুষদের জন্য সাধারণ নয়, তবে গর্ভাবস্থার সময় নারীদের মধ্যে পেটের চাপ বেড়ে যায় এবং এর ফলে হার্নিয়া তৈরি হতে পারে। পুরুষের ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থা প্রভাবিত না করলেও, প্রচুর শারীরিক চাপ বা অতিরিক্ত চাপ হার্নিয়ার ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
হার্নিয়া থেকে মুক্তির উপায়
হার্নিয়া থেকে মুক্তি পেতে সাধারণত অস্ত্রোপচারই সবচেয়ে কার্যকরী ও নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি। তবে, কিছু পরিস্থিতিতে প্রাথমিক পর্যায়ে লক্ষণগুলো কমানোর জন্য কিছু সাময়িক পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। এখানে হার্নিয়া থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সম্ভাব্য উপায়গুলি আলোচনা করা হলো:
১. অস্ত্রোপচার (Surgery)
হার্নিয়া একমাত্র স্থায়ীভাবে সারানোর উপায় হল অস্ত্রোপচার। এটি বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, যেমন:
- ওপেন সার্জারি: এতে ত্বকের একটি বড় ক্ষত তৈরি করে হার্নিয়া সংশ্লিষ্ট অংশ সারানো হয়।
- ল্যাপারোস্কোপিক (মিনিমালি ইনভ্যাসিভ) সার্জারি: এতে খুব ছোট ক্ষত তৈরি করে হার্নিয়া সারানো হয়, যা দ্রুত সেরে ওঠার সুযোগ দেয় এবং কম ব্যথা হয়।
অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে হার্নিয়ার প্রভাবিত অংশে আবার মেষ (mesh) স্থাপন করা হয়, যা সেই অংশকে সমর্থন দেয় এবং হার্নিয়া পুনরায় হতে না দেয়।
২. লাইফস্টাইল পরিবর্তন
হার্নিয়া থেকে মুক্তির জন্য কিছু জীবনধারা পরিবর্তনও সহায়ক হতে পারে, বিশেষত অস্ত্রোপচারের পর পুনরুদ্ধারের জন্য:
- ওজন নিয়ন্ত্রণ: অতিরিক্ত ওজন হার্নিয়ার সমস্যাকে আরও খারাপ করতে পারে, তাই স্বাস্থ্যের জন্যও সঠিক ওজন বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
- কোষ্ঠকাঠিন্য রোধ: কোষ্ঠকাঠিন্য হার্নিয়ার জন্য একটি বড় কারণ হতে পারে, কারণ এটি পেটে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। তাই প্রচুর পানি পান, আঁশযুক্ত খাবার এবং সুষম খাদ্য গ্রহণ করা উচিত।
- ভারী কিছু তোলার সময় সতর্কতা: ভারী কিছু তোলার সময় সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত। ভুলভাবে কিছু তুললে হার্নিয়া আরও খারাপ হতে পারে।
- সক্রিয় জীবনযাপন: নিয়মিত ব্যায়াম করলে পেশিগুলি শক্তিশালী হয়, যা হার্নিয়ার রিস্ক কমাতে সাহায্য করতে পারে।
৩. হার্নিয়া বেল্ট বা সাপোর্ট
হার্নিয়া বেল্ট বা সাপোর্ট ব্যবহার করা যেতে পারে, বিশেষ করে যদি আপনি অস্ত্রোপচারের পর পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়া শুরু করে থাকেন। এটি তাড়াতাড়ি তোলার কাজ থেকে বিরত রাখতে পারে এবং অস্থায়ীভাবে ব্যথা কমাতে সহায়ক হতে পারে। তবে, এটি কোনো স্থায়ী সমাধান নয় এবং দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয় না।
৪. ব্যথানাশক ঔষধ
হার্নিয়া সাধারণত ব্যথা সৃষ্টি করে থাকে, বিশেষত যদি এটি বড় হয়ে যায় বা কোনো রকমের সংক্রমণ হয়। ব্যথা কমানোর জন্য চিকিৎসক কিছু ব্যথানাশক ঔষধ প্রদান করতে পারেন। তবে এটি শুধু সাময়িক উপশম, এবং হার্নিয়ার মূল সমস্যা সমাধান করতে পারে না।
৫. ফিজিওথেরাপি বা ব্যায়াম (Physical Therapy)
ফিজিওথেরাপি বা বিশেষ ব্যায়াম কিছু ক্ষেত্রে হার্নিয়ার উপসর্গ কমাতে সাহায্য করতে পারে, বিশেষত যদি পেশির দুর্বলতা থাকে। তবে, যেকোনো ধরনের ব্যায়াম বা ফিজিওথেরাপি শুরু করার আগে একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত, কারণ ভুল ব্যায়াম পরিস্থিতি আরও খারাপ করতে পারে।
৬. প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
হার্নিয়ার পুনরাবৃত্তি রোধ করতে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে:
- ভারী কিছু তোলার সময় সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করুন: পেটের চাপ কমানোর জন্য সঠিক পদ্ধতিতে কিছু তোলা জরুরি।
- কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে মুক্তি পান: খাবারে পর্যাপ্ত আঁশ গ্রহণ এবং প্রচুর পানি পান করা কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে।
- বিরত থাকুন দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে বা বসে থাকার থেকে: দীর্ঘ সময় বসে থাকা বা দাঁড়িয়ে থাকা পেটের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করতে পারে, যা হার্নিয়ার সমস্যাকে বাড়াতে পারে।
হার্নিয়া রোগের হোমিও ঔষধ
- Nux Vomica
- ব্যবহার: যদি হার্নিয়ার সমস্যার সাথে কোষ্ঠকাঠিন্য, অতিরিক্ত চাপ, বা পেটের অস্বস্তি থাকে, তবে Nux Vomica সহায়ক হতে পারে।
- লক্ষণ: অস্বস্তি বা চাপ অনুভূতি, বিশেষত খাবার খাওয়ার পর। এটি পেটে গ্যাস জমে যাওয়ার অনুভূতি বা কোষ্ঠকাঠিন্যের সাথে সম্পর্কিত।
- Arnica Montana
- ব্যবহার: আঘাত বা আঘাতের কারণে হার্নিয়া দেখা দিলে Arnica সাহায্য করতে পারে।
- লক্ষণ: যেকোনো ধরনের আঘাত বা চোট থেকে অতিরিক্ত অস্বস্তি বা ব্যথা। এটি টিস্যু পুনরুদ্ধারে সহায়ক হতে পারে।
- Conium Maculatum
- ব্যবহার: যখন পেটে বা হার্নিয়ার স্থান গভীর ব্যথা অনুভূত হয়, Conium Maculatum ব্যবহার করা যেতে পারে।
- লক্ষণ: বিক্ষিপ্ত বা ধারালো ব্যথা, যা অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকে।
- Abies Nigra
- ব্যবহার: এটি কিছু ক্ষেত্রে ইনগুইনাল হার্নিয়া (ইনগুইনাল ক্যানাল দিয়ে বের হওয়া অংশ) বা পেটের দিকের চাপ কমাতে সহায়তা করতে পারে।
- লক্ষণ: পেটের নিচে চাপ বা ভারী অনুভূতি, বিশেষত দাঁড়িয়ে বা হাঁটলে।
- Natrum Muriaticum
- ব্যবহার: যদি হার্নিয়ার সাথে কোনো ধরনের মানসিক অস্থিরতা বা উদ্বেগ থাকে, Natrum Muriaticum সহায়ক হতে পারে।
- লক্ষণ: শারীরিক সমস্যার সাথে মানসিক চাপ, উদ্বেগ বা মনোভাবের পরিবর্তন।
- China Officinalis
- ব্যবহার: যখন হার্নিয়ার কারণে পেটের স্ফীতি বা গ্যাস জমে যায়, China Officinalis কার্যকর হতে পারে।
- লক্ষণ: পেটের অস্বস্তি, গ্যাস, বা অতিরিক্ত স্ফীতি, বিশেষ করে খাবার খাওয়ার পর।
- Sepia
- ব্যবহার: Sepia শরীরের দুর্বলতা এবং হালকা হার্নিয়ার উপসর্গ দূর করতে সহায়ক হতে পারে।
- লক্ষণ: পেটের নিচে ভারী অনুভূতি, এবং খুব কম শক্তি বা ক্লান্তি অনুভূতি।
হোমিওপ্যাথিক ঔষধ ব্যবহারের সময় কিছু সতর্কতা মেনে চলা গুরুত্বপূর্ণ। যদিও হোমিওপ্যাথি স্বাভাবিকভাবে নিরাপদ এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম, তবুও ভুলভাবে বা অদক্ষতার সাথে ব্যবহৃত হলে এটি কিছু সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
যেকোনো সমস্যার জন্য কোন ঔষধ ব্যবহার করবেন, সেটা নির্ধারণে একজন অভিজ্ঞ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের পরামর্শ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।