Breaking News

এপিস মেল

এপিস মেলিফিকা (Apis Mellifica)

ভূমিকা:

মৌমাছি বা হানি-বী একটি গুরুত্বপূর্ণ ঔষধি উপাদান, যা প্রাকৃতিকভাবে ক্ষুদ্র মৌমাছির দ্বারা তৈরি হয়। মৌমাছির শারীরিক গঠন ও বিষাক্ততা, বিশেষ করে মৌমাছির হুল ফোটানোর প্রভাব, অনেক রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। মৌমাছির বিষ বা ক্লোরোফরম দ্বারা কিছু বিশেষ অরিষ্ট তৈরি করা হয়, যা বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা মোকাবিলা করতে সহায়তা করে।

এটি প্রাথমিকভাবে মৌমাছির হুল বা বিষের থলির মাধ্যমে তৈরি করা হয়। এমনকি বিভিন্ন টিস্যু বা অঙ্গের উপরে ক্ষুদ্র নষ্টাবস্থা বা অরিষ্ট সৃষ্টি করতে এপিসের ব্যবহার হয়।

এপিস মেলিফিকা (Apis Mellifica) এর ব্যবহার প্রধানত প্রদাহ, ফোলা, এবং ত্বক সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা নিরাময়ে কার্যকর। এপিস মেলিফিকা একাধিক শারীরিক, মানসিক এবং অনুভূতিগত লক্ষণ ও উপসর্গের জন্য উপকারী।

এপিসের মূল বৈশিষ্ট্য:

১। জ্বালা ও হুলবিদ্ধ বেদনা: এপিস মেল ব্যবহারে জ্বালা ও হুলবিদ্ধকরণের মতো তীব্র বেদনা অনুভূত হয়, বিশেষ করে চোখের পাতায়, গলায়, আঙুলের নখে, অর্শে, স্তনে (ম্যাস্টাইটিসে), ডিম্বাশয়ে, বা চর্মরোগে যেমন ইরিসিপেলাস, আমবাত ও কার্বঙ্কল প্রভৃতিতে।

২। শোথ বা স্ফীতি: মুখমণ্ডল, কান, চোখের পাতা (বিশেষত নীচের পাতা), গলা (ডিপথিরিয়া), জননাঙ্গে বিশেষ করে অন্ডকোষে, ত্বক, ইরিসিপেলাস ও আমবাতে, সর্বাঙ্গীন শোথ এবং উদরের শোথে এপিস মেল উপকারী। শোথ বা স্ফীতিতে বেদনার অনুভূতি কম থাকে বা সম্পূর্ণ বেদনা শূন্যতাও থাকতে পারে।

৩। মস্তিষ্কের রোগে সঙ্গতিহীন চিৎকার: আকস্মিক ও তীক্ষ্ণ চিৎকার যেমন সেরিব্রাল রোগে দেখা যায়, তা এপিসের উল্লেখযোগ্য লক্ষণ। এই ধরনের চিৎকার বিশেষ করে হাইড্রোসেফালাস, সেরিব্রোস্পাইনাল মেনিনজাইটিস, টাইফাস সেরিব্রালিস ইত্যাদি রোগে দেখা যায়, যেখানে এপিস ব্যবহার উপকারী হতে পারে।

৪। তৃষ্ণাহীনতা ও শোথজনিত অবস্থা: শোথ বা যন্ত্রণা উপশমের সময় তৃষ্ণাহীনতা দেখা যায়। এটি সাধারণত শোথ বা সবিরাম জ্বরের সময় আরো প্রকট হয়।

৫। শুকনো ও ঘর্মাক্ত ত্বক: এপিস ব্যবহারে ত্বক ক্রমশ শুকিয়ে যেতে পারে এবং ঘর্মাক্ত হতে পারে।

৬। দম বন্ধ বা শ্বাসকষ্ট: শ্বাসের প্রতিটি মুহূর্ত যেন শেষ নিঃশ্বাসের মতো অনুভূত হতে পারে, বিশেষ করে শোথ বা সবিরাম জ্বরের সময়।

৭। হ্রাস-বৃদ্ধি ও স্পর্শে সংবেদনশীলতা: ঘুমানোর পর বা গরমে শরীরের অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে, বিশেষত ঠান্ডা পরিবেশে আরাম পাওয়া যায়। স্পর্শে অত্যন্ত সংবেদনশীলতা অনুভূত হতে পারে, যেমন আঙ্গুলে বা ত্বকে স্পর্শে অতিরিক্ত অনুভূতি।

৮। উদরাময় বা বসে যাওয়ার কুফল: যেমন হাম, স্কার্লেটিনা, আমবাত বসে গেলে এপিস মেল উপকারী হতে পারে।

৯। অনৈচ্ছিক উদরাময়: মলদ্বার বিস্তৃত হয়ে উদরাময় ঘটতে পারে, যা এপিসের একটি প্রাথমিক লক্ষণ।

 

এপিসের অন্যান্য লক্ষণ:

১। স্পর্শে সংবেদনশীলতা: যেমন উদরে, জরায়ুতে এবং ডিম্বাশয়ে অত্যন্ত স্পর্শকাতরতা অনুভূত হয়।

২। অস্থির ঘুম ও তীব্র চিৎকার: মস্তিষ্কের রোগে রোগী গভীর ঘুমে থাকে, তবে মাঝে মাঝে তীব্র চিৎকার করে ওঠে।

৩। শুকনো ত্বক ও ঘাম: বিশেষ করে সবিরাম জ্বরে ত্বক শুকিয়ে যায় এবং ঘর্মাক্ত হয়ে ওঠে।

৪। প্রত্যেক শ্বাসের শেষ শ্বাস মনে হওয়া: এটি বিশেষত শ্বাসকষ্ট ও শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যা হতে পারে।

৫। স্কার্লেটিনার পরবর্তী শোথ: স্কার্লেটিনা রোগের পরেও এপিস ব্যবহৃত হতে পারে, বিশেষ করে যদি শোথের লক্ষণগুলো সাদৃশ্যপূর্ণ হয়।

 

আসুন আমরা এই সমস্ত লক্ষণগুলোকে শ্রেণীবদ্ধভাবে পর্যালোচনা করি:

মন (Mental Symptoms):

  • বিরক্তি, উদাসীনতা এবং অচৈতন্যভাব: রোগী একাগ্রচিত্তে চিন্তা করতে পারে না, অনেক সময় মনোযোগ দিতে অসুবিধা হয়।
  • চঞ্চলতা এবং ঈর্ষা: রোগী সাধারণত অস্থির থাকে, সর্বদা চঞ্চল এবং ঈর্ষাপরায়ণ।
  • ভীতির অনুভূতি: ভয় এবং রাগের অনুভূতি বৃদ্ধি পায়, মাঝে মাঝে তীব্র চিৎকার এবং হঠাৎ ভয়াবহ চমকানো।

শারীরিক লক্ষণ (Physical Symptoms):

মাথা:

  • মাথা ঘোরা এবং চাপ: মাথার পিছনে চাপ, মাথা ঘোরানো এবং হাঁচি দিয়ে মাথার ব্যথা বৃদ্ধি পায়।
  • হঠাৎ তীব্র ব্যথা: কখনো কখনো মাথায় ছুরি মারার মত তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়।

চোখ:

  • চোখে প্রদাহ এবং লালচে শোথ: চোখের পাতা ফুলে যায়, লাল হয় এবং জ্বালা বা হুলফোটানোর মত ব্যথা হয়। আলোকাতঙ্ক এবং চোখে প্রদাহের অনুভূতি থাকে।

কান:

  • কানে প্রদাহ: বাহ্যিক কান লাল এবং টানটান ব্যথাযুক্ত হতে পারে।

মুখমণ্ডল ও গলা:

  • মুখে ও গলায় প্রদাহ: মুখমণ্ডলে স্ফীতি এবং তীব্র যন্ত্রণা অনুভূত হয়, গলায় তীব্র ব্যথা এবং টনসিলের প্রদাহ দেখা দেয়।
  • ফোলা এবং স্ফীতি: গলা, ঠোঁট এবং মুখগহ্বরে প্রদাহ এবং স্ফীতি থাকে, যেমন ইরিসিপেলাস বা অন্যান্য ত্বক সমস্যা।

পেট এবং উদর:

  • পেটের ব্যথা এবং প্রদাহ: পেটে টানটান বা থেঁতলিয়ে যাওয়ার মত ব্যথা এবং উদরের একদিকে ফোলা এবং অস্বস্তি।
  • মল ও প্রস্রাবের সমস্যা: মল এবং প্রস্রাবের প্রবাহে সমস্যা থাকে, রক্তমিশ্রিত মল, অবিরাম প্রস্রাব এবং প্রস্রাবে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়।

যৌনাঙ্গ:

  • ডিম্বাশয়ের প্রদাহ এবং যন্ত্রণা: মহিলাদের ক্ষেত্রে ডিম্বাশয়ের প্রদাহ, ব্যথা এবং যৌন অঙ্গের অন্য যে কোনো সমস্যা দেখা দিতে পারে।

অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ:

  • শরীরের স্ফীতি: শরীরের বিভিন্ন অংশে স্ফীতি হতে পারে, যেমন হাঁটু, পা এবং আঙুলে হালকা ফুলে উঠা বা ব্যথা।

শ্বাসকষ্ট এবং জ্বর:

  • শ্বাসকষ্ট: শ্বাসকষ্ট এবং শ্বাসনালি প্রদাহের লক্ষণ দেখা দেয়। ফুসফুসের প্রদাহ এবং শ্বাসের অসুবিধা থাকতে পারে।
  • জ্বর: বিকালে শীতবোধ, তৃষ্ণা এবং ঠাণ্ডা অনুভূতি থাকে, ঘামের পর শরীর একেবারে শুকিয়ে যায়।

ঘুম:

  • ঝিমুনিভাব এবং চমকানো: রোগী ঘুমের মধ্যে হঠাৎ চমকিয়ে ওঠে এবং স্বপ্ন দেখে, প্রায়ই অবসন্ন অনুভূতি থাকে।

উপশম ও উদ্দীপনা:

  • ঠাণ্ডা পানি এবং মুক্ত বাতাসে: এপিস মেলিফিকার উপশম ঘটে ঠাণ্ডা পানি, মুক্ত বাতাসে বা শীতল পরিবেশে।

শক্তি :

  • মূল অরিষ্ট থেকে ৩০ শক্তি: এপিস মেলিফিকার শক্তি, সাধারণত হোমিওপ্যাথিক প্রস্তুতিতে শক্তির স্তর নির্ধারণ করে। “৩০C” বা “30CH” শক্তি হল একটি সাধারণ শক্তি, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। এর মানে হলো, মূল অরিষ্ট বা মৌমাছির বিষের মূল উপাদান ১টি ভাগ, ১০০ ভাগ মিশ্রিত প্রক্রিয়ায় ৩০টি স্তরে পাতলা করা হয়েছে। এই শক্তি অধিকাংশ রোগের জন্য উপযুক্ত।
  • শোথযুক্ত অবস্থায় নিম্নশক্তি ভালো কাজ করে: অর্থাৎ, যখন শরীরে প্রদাহ (শোথ) বা ফোলাভাব হয়, তখন এপিস মেলিফিকার নিম্ন শক্তি (যেমন ৩০C বা ২০০C) বেশি কার্যকরী হতে পারে। কারণ, নিম্ন শক্তি দ্রুত এবং তীব্রভাবে কাজ করে, এবং প্রদাহ বা ফোলা কমাতে সহায়তা করে।
  • ধীরে কাজ করা: কিছু ক্ষেত্রে, এপিস মেলিফিকা ধীরে কাজ শুরু করতে পারে, বিশেষ করে যখন শরীরে দীর্ঘদিন ধরে সমস্যা থাকে বা কোনো পুরনো রোগ থাকে। এমন পরিস্থিতিতে, এটি আস্তে আস্তে কাজ করতে শুরু করে এবং রোগীর শরীরের সিস্টেমে পরিবর্তন আনে।
  • প্রস্রাবের পরিমাণ বৃদ্ধি: এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ, যা দেখায় যে ঔষধটি রোগীর শরীরে কাজ শুরু করেছে। প্রস্রাবের পরিমাণ বৃদ্ধি হওয়া সাধারণত তখন ঘটে, যখন শরীর থেকে টক্সিন বের হতে শুরু করে বা শরীরের পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এটি রোগীর পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ার একটি ভাল লক্ষণ।

 

এপিস মেল: পর্যালোচনা

  • এপিস মেলের প্রধান লক্ষণ হলো হুলবিদ্ধ, তীক্ষ্ণ ও দ্রুত বেদনা, যা মৌমাছির হুল ফোটানোর মতো তীব্র হতে পারে। এই বেদনা বিশেষত সেরাস মেমব্রেন বা মস্তিষ্কের আশেপাশে প্রভাব ফেলতে পারে, এবং তখন রোগী আকস্মিকভাবে তীব্র চিৎকার করতে পারে, যা “ক্রাই সেরিব্রেলি” নামে পরিচিত। এই ধরনের বেদনা হাইড্রোসেফালাস, সেরিব্রাল মেনিনজাইটিস, টাইফাস সেরিব্রালিস ইত্যাদি রোগের মধ্যে সাধারণ।
  • এপিস মেল যখন শ্লৈষ্মিক ঝিল্লি বা গলায় ব্যবহার করা হয়, তখন তীব্র বেদনা ও শীতলতা অনুভূত হতে পারে। বিশেষ করে ডিম্বাশয়ে এপিস মেল ব্যবহারে উন্নতি দেখা গেছে। ক্যান্সার রোগে যখন হুলফোটানো বা তীক্ষ্ণ বেদনা উপস্থিত থাকে, তখনও এপিস উপকারী হতে পারে।
  • ডাঃ হেরিং এপিসের বেদনা বর্ণনা করেছেন: “বিশেষ করে চোখে, চোখের পাতায়, কানে, মুখমণ্ডলে, ঠোঁটে, জিভে, গলায়, মলদ্বারে ও অন্ডকোষে হুলফোটানো বেদনা দেখা গেলে এপিস মেল উপযোগী।”
  • এপিসের কার্যকারিতা সাধারণত সেলুলার টিসুতে দেখা যায়, যেখানে শোথ বা স্ফীতি থাকে। এটি সাধারণত প্রদাহের শুরুতে, বিশেষ করে যখন সেরাস মেমব্রেন বা মিউকাস মেমব্রেন আক্রান্ত হয়, তখন উপকারী।
  • ডিপথিরিয়াতে, যখন গলা ফুলে যায় এবং শ্বাসকষ্ট হতে শুরু করে, এপিস একমাত্র উপকারী ঔষধ হিসেবে দেখা যায়। এর মাধ্যমে শোথের লক্ষণগুলি দূর করা যায়।

হোমিও ডাক্তার বাড়ি চিকিৎসকের পরামর্শ :

হোমিওপ্যাথিক ঔষধ ব্যবহারের সময় কিছু সতর্কতা মেনে চলা গুরুত্বপূর্ণ। যদিও হোমিওপ্যাথি স্বাভাবিকভাবে নিরাপদ এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম, তবুও ভুলভাবে বা অদক্ষতার সাথে ব্যবহৃত হলে এটি কিছু সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

যেকোনো সমস্যার জন্য কোন ঔষধ ব্যবহার করবেন, সেটা নির্ধারণে একজন অভিজ্ঞ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের পরামর্শ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

<script async src="https://pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js?client=ca-pub-7254298778630529"
     crossorigin="anonymous"></script>